ক্রিকেটলোকে স্পিনের জাদুকর

Spread the love

  নিজস্ব প্রতিবেদন: আহা, জীবন! কত ঠুনকো! কতইবা বয়স হয়েছিল তাঁর। কত পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মৃত্যু তো আর এত সবের ধার ধারে না! তিনি বলে বলে বিপক্ষের উইকেট নিয়েছেন। আর মৃত্যু। কিনা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মাত্র ৫২ বছর বয়সেই জীবনটা ছিনিয়ে নিল তাঁর থেকে! শেষ ইচ্ছে অসমাপ্ত রেখেই চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন। ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের কোচ হওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। মাত্র দিনচারেক আগেই নিজের এই ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু পূরণ হল না শেষ ইচ্ছে। তার আগেই চলে গেলেন এই অজি প্লেয়ার। মৃত্যুকালে তিনি থাইল্যান্ডে ছিলেন বলে খবর। ওয়ার্নের এজেন্সির তরফে এই বিষয়ে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘শেন ওয়ার্নকে ওনার বাংলোয় নিষ্প্রাণ অবস্থায় পাওয়া যায়। মেডিকেল দল নিজেদের পুরো চেষ্টা করেও তাঁকে আর ফেরাতে পারেনি। উনার পরিবার এই সময় একা থাকতে চায় এবং সময়মতো এই বিষয়ে বাকি তথ্য দেওয়া হবে।’ তিনি যখন ক্রিকেট থেকে অবসর নেন তখন তাঁর নামের পাশে টেস্টে ৭০৮ উইকেট, যা তখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ। কিন্তু শুধুমাত্র ৭০৮ উইকেট, বা তাঁর একের পর এক বিষাক্ত লেগ স্পিনে বিপক্ষ ব্যাটারদের আউট হওয়া দিয়ে হয়তো মাপা যাবে না শেন ওয়ার্নকে। বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম বর্ণময় চরিত্র তিনি। রেকর্ডের খ্যাতির পাশে সেখানে সমানভাবে উজ্জ্বল যৌন কেলেঙ্কারি। কোনও কিছুই লুকিয়ে করেননি ওয়ার্ন। বুক চিতিয়ে, হাসি মুখে সামনে দাঁড়িয়েছেন। তাই মাত্র ৫২ বছর বয়সে তিনি চলে যাওয়ায় হতবাক ক্রিকেট দুনিয়া। এখনও মেনে নিতে পারছেন না অনেকে। হঠাৎ করেই যেন শেষ হয়ে গেল ক্রিকেটের একটা যুগ। ১৯৯২ সালে ভারতের বিরুদ্ধেই টেস্টে অভিষেক হয়েছিল ওয়ার্নের। পরের বছর সুযোগ পান অস্ট্রেলিয়ার এক দিনের দলে। তার পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল লেগ স্পিনের জাদু। কব্জির মোচরে লেগ স্টাম্পের বাইরের দিকের রাফ (বোলারের জুতোর ফলে পিচের মধ্যে খুঁড়ে যাওয়া অংশ) ব্যবহার করে তাবড় তাবড় ব্যাটারদের ভেল্কি দেখিয়েছেন। কখনও বল পায়ের পিছন দিক দিয়ে স্টাম্পে গিয়ে লেগেছে। কখনও আবার ব্যাটারের সামনে দিয়েই অফ স্টাম্প নিয়ে উড়ে গিয়েছে। অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার হাতে ইংল্যান্ড দলের ভরাডুবি হওয়ার পর চাকরি হারান ইংরেজদের প্রধান কোচ ক্রিস সিলভারউড। এরপর আলোচনা চলছিল সিলভারউডের জায়গায় কাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। এই আলোচনায় নাম ছিল শেন ওয়ার্নেরও। স্কাই স্পোর্টসকে মাত্র চারদিন আগে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে ওয়ার্ন জানিয়েছিলেন, ইংল্যান্ড দলের দায়িত্ব পেলে বেশ খুশিই হবেন তিনি। এ ব্যাপারে ওয়ার্ন বলেছিলেন, আমি এটি (ইংল্যান্ড দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব নেওয়া) করতে চাই। ইংল্যান্ড দলের কোচ হওয়ার জন্য এটি দুর্দান্ত সময়। তিনি আরও বলেছিলেন, আমি মনে করি এটি অসাধারণ একটি কাজ হবে। এখানে অনেকের সঙ্গে কাজ করা যাবে। ইংল্যান্ড দলে অনেক ভালো খেলোয়াড় আছে। কতইবা বয়স হয়েছিল তাঁর। গত সেপ্টেম্বরে ৫২তম জন্মদিন উদ্‌যাপন করেছিলেন। কত পরিকল্পনা ছিল তাঁর। এই তো, দুদিন আগেও টুইটে জানিয়েছিলেন, নতুন ফিটনেস প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছেন, জুলাইয়ের মধ্যে শরীরের মেদ ঝরিয়ে ঝরঝরে হয়ে যেতে চান। কিন্তু মৃত্যু তো আর এত সবের ধার ধারে না! ১২ ঘণ্টা আগেও এক টুইটে যিনি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের আরেক কিংবদন্তি রডনি মার্শের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছিলেন, তিনি নিজেই আজ কিছুক্ষণ আগে হয়ে গেলেন শোকবার্তার শিরোনাম! গত কয়েকদিনে তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কোনও খবর তো পাওয়া যায়ইনি, বরং নিজের কয়েকবছর আগের মেদহীন শরীরের একটা ছবি দিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি টুইটে লিখেছিলেন, ‘মেদ ঝরানোর মিশন সবেমাত্রই শুরু হলো (১০ দিন হয়েছে)। লক্ষ্য হচ্ছে জুলাইয়ের মধ্যে কয়েক বছর আগের এই অবস্থায় ফিরে যাওয়া…!’ সাম্প্রতিক যেকোনও ইস্যুতে মতামত জানাতে খুবই সক্রিয় ছিলেন। কখনও ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে হতাশা জানিয়েছেন, তো কখনও আবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রডনি মার্শকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ফুটে উঠেছে। সেই রডনি মার্শ কিছু সময় আগেই অন্যলোকে চলে গেছেন, ক্রিকেট সে শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শেন ওয়ার্নও ১২ ঘণ্টা আগে টুইটে নিজের শোকার্ত মনের খবর জানিয়েছিলেন, ‘রড মার্শের মৃত্যুর খবরে খুব খারাপ লাগছে। আমাদের অসাধারণ এই খেলাটার একজন কিংবদন্তি তিনি, হাজারো তরুণ ছেলেমেয়ের অনুপ্রেরণা। ক্রিকেট তাঁর ভাবনাজুড়ে সব সময়ই ছিল। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা তাঁর কাছ থেকে কত কিছু শিখেছে! রস (রড মার্শের স্ত্রী) ও পরিবারের জন্য ভালোবাসা জানাই।’ ১২ ঘণ্টা পর সেই ওয়ার্ন নিজেই অন্যলোকের যাত্রী! ক্রিকেটের কিংবদন্তিদের সংক্ষিপ্ততম তালিকায় তো তাঁর নামও থাকবে, হাজারো তরুণের অনুপ্রেরণা তো তিনিও। লেগ স্পিনকে শিল্পের পর্যায়ে পাকিস্তানের আবদুল কাদির নিয়ে গেছেন ঠিকই, কিন্তু এই শিল্পকেই তরুণদের হৃদয়ে গেঁথে দেওয়ার কৃতিত্ব তো সোনালি চুলের অস্ট্রেলিয়ানেরই! সেই শেন ওয়ার্নই আর নেই! ১২ ঘণ্টা আগে যাঁর জন্য শোক ঝরেছিল, সেই মার্শের যাত্রাসঙ্গী হওয়ার বুঝি তাড়া ছিল তাঁর! আহা, জীবন! কত ঠুনকো!
Spread the love

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।