পবিত্র রমজান মাসে জেনে নিন নাখোদা মসজিদের ইতিহাস 

Spread the love

সৌম্যজিৎ চক্রবর্তী: তিলেতিলে তৈরি হওয়া এই স্থাপত্যটি কলকাতার অন্যতম দ্রষ্টব্য। একটি গম্বুজ, ১৫০ ফুট উচ্চতার দুটি বড় মিনার, ১০০ ফুট উচ্চতার ২৫টি ছোট মিনার, গ্রানাইটে গড়া দু’তলা চাতাল। প্রায় ১৫ হাজার মুসলমান এই দুই চাতালে নামাজ পড়তে পারেন। ঈদে বা বিশেষ দিনে লাখ ছাড়িয়ে যায় সেই সংখ্যা। পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম মসজিদ। মহানগরের সবথেকে বড়ো মসজিদ বলে একে ‘বঢ়ি মসজিদ’ নামেও ডাকা হয়। কলকাতার নাখোদা। ফার্সিতে নাখোদার আভিধানিক অর্থ জাহাজে জিনিসপত্র আমদানি-রফতানির ব্যবসা করেন এমন ব্যক্তি বা নাবিক। ইতিহাস বলে, গুজরাটের কচ্ছে কুচ্চি মেমন জামাত নামে কিছু সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলমান বাস করতেন। তাদের নেতা আব্দুর রহিম ওসমান ছিলেন সমুদ্রবণিক। তিনি ১৯২৬-এর ১১ সেপ্টেম্বর কলকাতার জাকারিয়া ও রবীন্দ্র সরণির সংযোগস্থল চিৎপুরে এই মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু করেন। যা শেষ হয় ১৯৪২-এ। তৎকালীন সর্ববৃহৎ নির্মান প্রতিষ্ঠান ম্যাকিনটশ বার্ন বিহারের টোলপুর থেকে গ্রানাইট পাথর এনে লাল বেলেপাথর দিয়ে বানানো ইন্দো-সেরাসেনিক পদ্ধতিতে তৈরি করে এই মসজিদটি। আর মসজিদটির ভিতরের অংশ মুড়ে দেওয়া হয় শ্বেতপাথরে। মসজিদের প্রধান ফটক বানানো হয় ফতেপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজার অনুসরণে। গুজরাটের কচ্ছের ওই সমুদ্রবণিক আব্দুর রহিম ওসমান তাঁর উপার্জিত প্রায় লাখ পনেরো টাকা ব্যয় করেন মসজিদ প্রতিষ্ঠার জন্য। তাঁর পেশা নাবিক বা নাখোদার নামানুসারেই এই মসজিদটির নামকরণ হয় নাখোদা মসজিদ। আগে এখানে একটি ছোটো মসজিদও ছিল। এই মসজিদটির আশেপাশে নানা ধরণের পসরা সাজিয়ে বসেন ব্যাপারীরা। শোনা যায়, এই দোকানগুলোয় এমনকিছু জিনিসপত্র পাওয়া যায়, যেগুলো পৃথিবীর অন্য কোথাও আর পাওয়া যায়না। কস্তুরীর আতর, মিষ্টি জর্দা, নকশি করা নামাজি টুপি, চুরিদার, কুর্তা পাঞ্জাবি, সেরওয়ানি, বোরখা, বাদ্যযন্ত্র – হরেক জিনিসের পসরা সাজানো থাকে। এছাড়াও ইসলামী চিকিৎসার বিখ্যাত – ইউনানী ওষুধ। এমনকি বাদ্যযন্ত্রেরও একটি বড় বাজার আছে এখানে। খুঁজলে আসল কস্তুরী মৃগ-নাভীর আতরও মিলতে পারে। শুধু হরেক পসরাই নয়, নানা স্বাদের খাবারের জন্যও খ্যাত এই চত্বর। বিভিন্ন ধরনের কাবাব, নানা রঙের ফিরনি, হালিম, সিমাই রুটি, মিষ্টি, ফালুদা, শুকনো ফল বা খেজুর। আর মসজিদের কাছেই “রয়াল ইন্ডিয়ান হোটেলে”র বিখ্যাত বিরিয়ানি ও চিকেন চাপ। খাদ্যরসিকের যেন স্বর্গরাজ্য। ঈদের সময় জাকারিয়া স্ট্রিটে এক ধরনের মাছ ও মাংস ভাজা অন্য এক স্বাদের হদিস দেয়। মাছটি হল- “মাহি আকবরি” – এটি কাতলা মাছ। আর ভাজা চিকেন – “চিকেন চাংজেজি”। আর আছে দই হলুদ মাখনো অবস্থাতেই ওজন করা মাছ বা মাংস। তারপর ভাজা হলে টুকরো টুকরো করে বিক্রি হয়। আর নাখোদা মসজিদ কেবলমাত্র মুসলমানদের একটি উপাসনা গৃহই নয়, বরং দেশী বিদেশী পর্যটকদের কাছে অসামান্য এক স্থাপত্য ও শিল্পময়তার একান্ত দর্শনীয় স্থান। মসজিদের উঁচু মিনারের সবুজ আলো জ্বালা- নেভার দ্বারা বোঝানো হয় রমজানের উপবাস শুরু ও শেষ। ঈদের সময় কলকাতা যেন থমকে যায় নাখোদার চারপাশে। আলোর ঝলমলানি, চুড়ির টুংটাং শব্দ নতুন পোষাক ও আতরের ম ম করা গন্ধে ভরে ওঠে পুরো জাকারিয়া স্ট্রিট। সাদা মার্বেল পাথরের মেঝে, ঝাড়বাতি, বেলজিয়াম কাচ, বিশাল নমাজ পড়ার জায়গা, প্রাচীন কাঠের ঘড়ি। সূক্ষ্ম অলংকরণ এবং শৈল্পিক কল্পনার একটি অনন্যসাধারণ নিদর্শন। দেওয়ালের গায়ে ইতিহাস এখানে এখনও যেন ফিসফিস করে কথা বলে যায়।
Spread the love

One Reply to “পবিত্র রমজান মাসে জেনে নিন নাখোদা মসজিদের ইতিহাস ”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।