ডাঃ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: দোলের দিন ছুটি। পেশেন্ট দেখার ঝামেলা নেই। একদিন পরেই আবার রবিবার। সবমিলিয়ে হঠাৎ করে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো দিনতিনেকের ছুটি। তাই ফাগুনের আগুন-পলাশ দেখতে ঠিক করলাম পুরুলিয়া যাবো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গুগল ম্যাপটা খুলে দেখলাম প্রায় ৭ ঘন্টা ১৬ মিনিট লাগবে পুরুলিয়ার কুশলপল্লীতে পৌঁছতে। এখন প্রায় 12 টা 10 মিনিট। রাস্তায় ব্রেক দিলে আরো ঘন্টা খানেক। সব মিলিয়ে রাত 9 টার আগে পৌঁছবো না। বাইরে বেশ গরম। গাড়িতে উঠে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। কোনা এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে দিল্লী রোড ধরে আমদের xylo ছুটতে শুরু করলো। আসলে গ্রাম বাংলার রূপ দেখার নেশায় এই ধরণের লং ড্রাইভ-এ মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়াও একটা প্যাশন। বসন্তের পুরুলিয়া অবশ্য একটু অন্যরকম। নীল আকাশ আর মাটির সবুজের সমারোহর মাঝে লাল পলাশের অসাধারণ দৃশ্য আপামর বাঙালির ভালোলাগার অন্যতম জায়গা। আর এখানেই পুরুলিয়ার মাটি অন্যদের থেকে আলাদা। নিভে আসা সূর্যের গেরুয়া আলোর বুক চিরে শাল-পলাশ-শিমুলের পাশ কাটিয়ে আমরা যখন অযোধ্যা হিল টপের কুশলপল্লীতে পৌঁছলাম তখন রাত আটটা। হোটেলের ম্যানেজার আমাদের ঘরের ভেতর পৌঁছে দিলেন। হাত মুখ ধুয়ে এককাপ চা নিয়ে সামনের কাঠের ব্যালকনি এসে দাঁড়ালাম, পূর্ণিমার চাঁদ একমুখ হেঁসে আমাদের আপন করে নিল। আসলে পুরুলিয়া এক অনন্ত বৈচিত্র্যের এক অন্য রকম জায়গা।প্রকৃতি তার সব কিছুই যেন উজার করে ঢেলে দিয়েছে এই জেলায়। অল্প উঁচু টিলার পাহাড়, ঝর্ণার ঝিরি ঝিরি কলতান, বড় বড় ঝিল আর অনাবিল সবুজে সাজানো এক মনোরম স্বর্গীয় পরিবেশ। পুরুলিয়া বলতেই অযোধ্যা, বাঘমুন্ডি,বরন্তী, গড় পঞ্চকোট, মুরগামা, বামনী ঝর্ণা, মার্বেল রক এইসব জায়গার নাম চোখের সামনে ভেসে আসে। আমরা রাতের ডিনার শেষ করে একপ্রস্ত ঘুরাঘুরি করে শুতে গেলাম। পরের দিন সকাল সকাল উঠে প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরোলাম। ঝাঁ চকচকে রাস্তা ধরে পাহাড় আর জঙ্গল এর মধ্যে দিয়ে একে একে আপার ড্যাম, লোয়ার ড্যাম, বামনী ফলস, মার্বেল রক, মাচকানদা ফলস ঘুরে একটা জঙ্গলের ভিতর ঢুকলাম। কিছুটা গিয়েই গাড়ি থেকে নেমে মেঠো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। একদিকে নানাধরনের সবুজ রঙের সমারোহ আর একদিকে লাল আর লাল। হ্যাঁ পলাশ আর পলাশ। বসন্তের রং যে লাল সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে পুরুলিয়ায় প্রতিটি ঋতুর আলাদা আলাদা রূপ আছে। তাই পুরুলিয়াকে জানতে হলে, ভালবাসতে হলে সব ঋতুতেই একবার করে আসতে হবে। কয়েকটি মাত্র দর্শনীয় স্থানের নাম দিয়ে এই জেলাকে জানা যাবে না। পলাশের লাল রঙকে মনের লাল রঙের সাথে মিশিয়ে আমরা অনেকটা সময় জঙ্গলের ভিতর কাটিয়ে প্রায় আড়াইটে নাগাদ কুশলপল্লীতে ফিরে এলাম। এরপর দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘন্টা খানেক পর রোদের তেজ একটু কমতে আমরা বের হলাম। এবার গন্তব্য স্থান মরুগুমা ড্যাম। প্রায় সতেরো কিমি দূরত্ব যেতে 45 মিনিট সময় লাগলো। পরন্ত সূর্যের আলোয় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এই রাস্তা টা বেশ রোমাঞ্চকর। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাস্তা টা বেশ সরু হওয়ায় দু এক বার উল্টো দিকের গাড়ি হঠাৎ করে আমাদের গতি কে থামিয়ে দিয়েছে। একটু অসতর্ক হলে যখন তখন accident হতেই পারে। যাইহোক, আমরা যখন মুরুগুমা ড্যাম এ পৌঁছলাম তখন প্রায় সূর্যাস্ত। দুরে অযোধ্যা-বাঘমুণ্ডির পাহাড়ের আড়ালে আস্তে আস্তে সূর্য ডোবার সাক্ষী হয়ে আমরা থাকলাম। প্রায় মিনিট পনেরো ধরে এই অপরূপ সূর্যাস্ত দেখার পর আমরা ড্যাম এর দিকে এগোলাম। এখানেই আমার কলেজের জুনিয়র কিংশুক এর সাথে দেখা। প্রায় হঠাৎ করে আট বছর পর দেখা। চলন্ত গাড়ী থেকেই কয়েক সেকেন্ড এর কথা। এরপর মরুগুমা ড্যাম এর দিক থেকে ফেরার সময় আর এক সিনিয়র কলেজের দাদার সাথে দেখা। ডঃ অনিন্দ্য সরকার রায়গঞ্জ এর বিখ্যাত অর্থপেডিক সার্জন, ফামিলি নিয়ে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে আমরা ফেরার জন্য গাড়িতে উঠলাম। এর মধ্যে অবশ্য এক প্রস্থ চা খাওয়া হয়ে গেছে গল্প করতে করতে । ততক্ষণে অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে। পূর্ণিমার চাঁদ মাথার উপর যেন ঝলসানো রুটির মতো। চাঁদ এর আলোয় জঙ্গলের মধ্যেকার রাস্তা এক পার্থিব শোভায় শোভিত। সারাদিনের ব্যস্ততার পর কুশলপল্লীতে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম যে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেব, কিন্তু সেগুরেবালি। পাবলোর বায়না পুলে চান করতে যাবে। অগত্যা যেতেই হল এবং নামতেও হল। এইসব করে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করে শুতে শুতে প্রায় এগারোটা বেজে গুলো। পরের দিন আমার রুটিনটা একটু অন্যরকম ছিল। লোকাল গাইড ঠিক করে রেখেছিলাম পাখির ছবি তুলব বলে। আজকে আমি একাই বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় ভোর 5 টা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য তিয়াসি ও পাড়কিড়ি গ্রামের ঢোলবুরু, ডুংরি,রাজবুরু পাহাড়। শুভ্র পাখিরা, লোকাল গাইড আজ আমার সঙ্গী। প্রায় 23 কি মি যাওয়ার পর আমি আমার গন্তব্য স্থলে পৌঁছলাম। শুভ্র আগে থেকেই আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। গাড়িটা একটা ফাঁকা মাঠের উপর রেখে পায়ে হেঁটে আমরা ঢোলবুরু পাহাড়ের তলা দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কখনো মাঠের আল, আবার কখনো এবরো- খেবরো পাথুরে জমির উপর দিয়ে আমরা চলতে থাকলাম। রোদ চড়া না হওয়ায় আমরা বেশ সময় নিয়ে বিভিন্ন পাখির ছবি তুলতে থাকলাম। এখানকার পাহাড় গুলো আসলে উঁচু টিলা। এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রায় 3 ঘন্টা বার্ডিং করে আমরা ব্রেকফাস্ট করার জন্যে স্থানীয় একটি হোটেল এ এলাম। আটার তৈরী পুরি আর আলু- ডালের তরকারি, সাথে ডিম সেদ্ধ, একদম অন্যরকম একটা ফিলিংস। রোদের তেজ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকায় আরও ঘন্টা দুয়েক বার্ডিং করে একটা পাহাড়ের তলায়( ডুংরি) জঙ্গলের মধ্যে ছায়ায় কিছুটা থাকলাম। দুরের পলাশের অসাধারণ দৃশ্য আমাদের চোখ এড়ালো না। গাড়িতে ওঠার আগে কয়েকটি মহুয়া গাছ চোখে পড়ল। সবমিলিয়ে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। রিসর্টে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম। বিকালে গন্তব্য চরিদা গ্রাম বা মুখোশ গ্রাম। ছৌ শিল্পের মুখোশ তৈরীর জন্য এই গ্রাম টি বিখ্যাত। প্রথমেই নয়ন সূএধর এর দোকানে গেলাম। শেষবার যখন এসেছিলাম তখনই আলাপ হয় নয়নের সাথে। বেশ কিছুক্ষণ নয়নের সাথে গল্প করলাম। এরপর পাশের দোকানের মনোরঞ্জন সূত্রধর এর সাথে আলাপ। বেশ কিছুক্ষণ এনার হাতের কাজ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের। কথা প্রসঙ্গে বললেন ছৌঁ শিল্পের কথা, তাদের নাচের কথা। কথায় কথায় জানতে পারলাম কোলকাতায় গিয়ে এই শিল্পী রা অনুষ্ঠান করলে 40/45 হাজার টাকার পারিশ্রমিক নেন। তিরিশ জনের এই গ্রুপ, সদস্যরা নিজেদের গাড়ী নিয়ে অনুষ্ঠান করতে যান। প্রায় তিন ঘণ্টার এক একটা পালা হয়। মনোরঞ্জন বাবু আরও বললেন বিগত বছর গুলোতে কোভিড পরিস্থিতিতে এই শিল্পকলা অনেকটাই মুখ থুবরে পড়েছে। এবার ফেরার পালা। লাল পলাশের দেশের ইতিহাস অনেক প্রাচীন ও ঐতিহাসিক তথ্যে সমৃদ্ধ।আমরা সকালের প্রাতরাশ সেরে যখন বেরোলাম তখন প্রায় সকাল এগারোটা l আমাদের গাড়ি অযোধ্যা হিলস এর রাস্তা ধরে ছুটতে শুরু করল ।ভুদার মোর পেরিয়ে কিছুটা গেলেই বান্দু সেতু। আর সেটা পেরিয়ে গেলেই দুদিকে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ আর লালের ছড়াছড়ি। পলাশ আর পলাশ। গাড়িতে উঠে ঠিক করলাম বরন্তী হয়ে ফিরবো। প্রায় 24 কিমি পথ পলাশ দেখতে দেখতে কখন যে ন্যাশনাল হাইওয়ে 32 ধরে ফেলেছি তার খেয়াল ছিল না l গাড়িতে যেতে যেতে গুগল ম্যাপ টা খুলে দেখলাম গড়পঞ্চকোট হয়ে গেলে ঘন্টাখানেক বেশী সময় লাগবে। তাই প্লান একটু চেঞ্জ করে ড্রাইভার কে বললাম গড় পঞ্চকোট চলো। প্রায় দুটো নাগাদ আমরা গড় পঞ্চকোট পৌঁছলাম। আদি কল্যাণেশ্বরী মন্দির, রাজমহল এর ধংসাবশেষ, গড় পঞ্চকোট পাহাড় ঘুরে দুপুরের লাঞ্চ চারুলতাতে করলাম। ভাত,ডাল, আলুপোস্ত, পোস্তর বড়া, রুই মাছের ঝাল, পাঁপড় আর চাটনি, আর ছেলে পাবলোর জন্য স্পেশাল চিকেন কারী। চারুলতা ক্যাফেটেরিয়া টি বেশ ছিমছাম, পরিষ্কার, খাবার ও বেশ ভাল, দাম নাগালের মধ্যেই। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বেরোতে যাব, এমন সময় স্ত্রী সোনালীর খুরততো ভাইদের সঙ্গে দেখা। বেশ কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে আমরা বরন্তী এর উদ্দেশ্যে বেরালাম । বরন্তী পৌঁছে লেকের ধারে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুললাম। এরপর আমাদের এইবারের ট্যুর এর শেষ গন্তব্যস্থল ভেটি গ্রাম। পলাশ দেখার শেষ ও প্রথম যদি কোনো জায়গা থাকে তবে তা এই ভেটি গ্রাম । আমরা গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে পলাশ বনের ভিতর দিয়ে এগোতে থাকলাম। প্রকৃতিকে এত কাছ থেকে দেখার এর থেকে আর কি ভালো হতে পারে। আকাশের নীল রঙের মধ্যে টকটকে লালের ঘনঘটা।কোন দিক ছেড়ে কোন দিকে তাকাবো, বোঝা দায়। মনের সাধে সবাই মিলে ছবি তুললাম। তবে মনের মণিকোঠায় যে রং লাগলো, তা যে সহজে ফিকে হবার নয় এটা ততক্ষণে বুঝে গেছি। আসতে আসতে সূর্য ডোবার পালা শুরু হল। টুপ করে সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এল। এবার ফেরার পালা। আবার পুরুলিয়ার মাটিতে ফিরে আসার ইচ্ছে নিয়ে গাড়ী তে গিয়ে বসলাম। পেছন থেকে পাবলোর ডাক….আবার আসতে হবে , পাপা। (ছবি: ডাঃ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়)
ডাঃ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: দোলের দিন ছুটি। পেশেন্ট দেখার ঝামেলা নেই। একদিন পরেই আবার রবিবার। সবমিলিয়ে হঠাৎ করে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো দিনতিনেকের ছুটি। তাই ফাগুনের আগুন-পলাশ দেখতে ঠিক করলাম পুরুলিয়া যাবো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গুগল ম্যাপটা খুলে দেখলাম প্রায় ৭ ঘন্টা ১৬ মিনিট লাগবে পুরুলিয়ার কুশলপল্লীতে পৌঁছতে। এখন প্রায় 12 টা 10 মিনিট। রাস্তায় ব্রেক দিলে আরো ঘন্টা খানেক। সব মিলিয়ে রাত 9 টার আগে পৌঁছবো না। বাইরে বেশ গরম। গাড়িতে উঠে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। কোনা এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে দিল্লী রোড ধরে আমদের xylo ছুটতে শুরু করলো। আসলে গ্রাম বাংলার রূপ দেখার নেশায় এই ধরণের লং ড্রাইভ-এ মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়াও একটা প্যাশন। বসন্তের পুরুলিয়া অবশ্য একটু অন্যরকম। নীল আকাশ আর মাটির সবুজের সমারোহর মাঝে লাল পলাশের অসাধারণ দৃশ্য আপামর বাঙালির ভালোলাগার অন্যতম জায়গা। আর এখানেই পুরুলিয়ার মাটি অন্যদের থেকে আলাদা। নিভে আসা সূর্যের গেরুয়া আলোর বুক চিরে শাল-পলাশ-শিমুলের পাশ কাটিয়ে আমরা যখন অযোধ্যা হিল টপের কুশলপল্লীতে পৌঁছলাম তখন রাত আটটা। হোটেলের ম্যানেজার আমাদের ঘরের ভেতর পৌঁছে দিলেন। হাত মুখ ধুয়ে এককাপ চা নিয়ে সামনের কাঠের ব্যালকনি এসে দাঁড়ালাম, পূর্ণিমার চাঁদ একমুখ হেঁসে আমাদের আপন করে নিল। আসলে পুরুলিয়া এক অনন্ত বৈচিত্র্যের এক অন্য রকম জায়গা।প্রকৃতি তার সব কিছুই যেন উজার করে ঢেলে দিয়েছে এই জেলায়। অল্প উঁচু টিলার পাহাড়, ঝর্ণার ঝিরি ঝিরি কলতান, বড় বড় ঝিল আর অনাবিল সবুজে সাজানো এক মনোরম স্বর্গীয় পরিবেশ। পুরুলিয়া বলতেই অযোধ্যা, বাঘমুন্ডি,বরন্তী, গড় পঞ্চকোট, মুরগামা, বামনী ঝর্ণা, মার্বেল রক এইসব জায়গার নাম চোখের সামনে ভেসে আসে। আমরা রাতের ডিনার শেষ করে একপ্রস্ত ঘুরাঘুরি করে শুতে গেলাম। পরের দিন সকাল সকাল উঠে প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরোলাম। ঝাঁ চকচকে রাস্তা ধরে পাহাড় আর জঙ্গল এর মধ্যে দিয়ে একে একে আপার ড্যাম, লোয়ার ড্যাম, বামনী ফলস, মার্বেল রক, মাচকানদা ফলস ঘুরে একটা জঙ্গলের ভিতর ঢুকলাম। কিছুটা গিয়েই গাড়ি থেকে নেমে মেঠো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। একদিকে নানাধরনের সবুজ রঙের সমারোহ আর একদিকে লাল আর লাল। হ্যাঁ পলাশ আর পলাশ। বসন্তের রং যে লাল সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে পুরুলিয়ায় প্রতিটি ঋতুর আলাদা আলাদা রূপ আছে। তাই পুরুলিয়াকে জানতে হলে, ভালবাসতে হলে সব ঋতুতেই একবার করে আসতে হবে। কয়েকটি মাত্র দর্শনীয় স্থানের নাম দিয়ে এই জেলাকে জানা যাবে না। পলাশের লাল রঙকে মনের লাল রঙের সাথে মিশিয়ে আমরা অনেকটা সময় জঙ্গলের ভিতর কাটিয়ে প্রায় আড়াইটে নাগাদ কুশলপল্লীতে ফিরে এলাম। এরপর দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে ঘন্টা খানেক পর রোদের তেজ একটু কমতে আমরা বের হলাম। এবার গন্তব্য স্থান মরুগুমা ড্যাম। প্রায় সতেরো কিমি দূরত্ব যেতে 45 মিনিট সময় লাগলো। পরন্ত সূর্যের আলোয় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এই রাস্তা টা বেশ রোমাঞ্চকর। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাস্তা টা বেশ সরু হওয়ায় দু এক বার উল্টো দিকের গাড়ি হঠাৎ করে আমাদের গতি কে থামিয়ে দিয়েছে। একটু অসতর্ক হলে যখন তখন accident হতেই পারে। যাইহোক, আমরা যখন মুরুগুমা ড্যাম এ পৌঁছলাম তখন প্রায় সূর্যাস্ত। দুরে অযোধ্যা-বাঘমুণ্ডির পাহাড়ের আড়ালে আস্তে আস্তে সূর্য ডোবার সাক্ষী হয়ে আমরা থাকলাম। প্রায় মিনিট পনেরো ধরে এই অপরূপ সূর্যাস্ত দেখার পর আমরা ড্যাম এর দিকে এগোলাম। এখানেই আমার কলেজের জুনিয়র কিংশুক এর সাথে দেখা। প্রায় হঠাৎ করে আট বছর পর দেখা। চলন্ত গাড়ী থেকেই কয়েক সেকেন্ড এর কথা। এরপর মরুগুমা ড্যাম এর দিক থেকে ফেরার সময় আর এক সিনিয়র কলেজের দাদার সাথে দেখা। ডঃ অনিন্দ্য সরকার রায়গঞ্জ এর বিখ্যাত অর্থপেডিক সার্জন, ফামিলি নিয়ে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে আমরা ফেরার জন্য গাড়িতে উঠলাম। এর মধ্যে অবশ্য এক প্রস্থ চা খাওয়া হয়ে গেছে গল্প করতে করতে । ততক্ষণে অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে। পূর্ণিমার চাঁদ মাথার উপর যেন ঝলসানো রুটির মতো। চাঁদ এর আলোয় জঙ্গলের মধ্যেকার রাস্তা এক পার্থিব শোভায় শোভিত। সারাদিনের ব্যস্ততার পর কুশলপল্লীতে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম যে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেব, কিন্তু সেগুরেবালি। পাবলোর বায়না পুলে চান করতে যাবে। অগত্যা যেতেই হল এবং নামতেও হল। এইসব করে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করে শুতে শুতে প্রায় এগারোটা বেজে গুলো। পরের দিন আমার রুটিনটা একটু অন্যরকম ছিল। লোকাল গাইড ঠিক করে রেখেছিলাম পাখির ছবি তুলব বলে। আজকে আমি একাই বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় ভোর 5 টা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য তিয়াসি ও পাড়কিড়ি গ্রামের ঢোলবুরু, ডুংরি,রাজবুরু পাহাড়। শুভ্র পাখিরা, লোকাল গাইড আজ আমার সঙ্গী। প্রায় 23 কি মি যাওয়ার পর আমি আমার গন্তব্য স্থলে পৌঁছলাম। শুভ্র আগে থেকেই আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। গাড়িটা একটা ফাঁকা মাঠের উপর রেখে পায়ে হেঁটে আমরা ঢোলবুরু পাহাড়ের তলা দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কখনো মাঠের আল, আবার কখনো এবরো- খেবরো পাথুরে জমির উপর দিয়ে আমরা চলতে থাকলাম। রোদ চড়া না হওয়ায় আমরা বেশ সময় নিয়ে বিভিন্ন পাখির ছবি তুলতে থাকলাম। এখানকার পাহাড় গুলো আসলে উঁচু টিলা। এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রায় 3 ঘন্টা বার্ডিং করে আমরা ব্রেকফাস্ট করার জন্যে স্থানীয় একটি হোটেল এ এলাম। আটার তৈরী পুরি আর আলু- ডালের তরকারি, সাথে ডিম সেদ্ধ, একদম অন্যরকম একটা ফিলিংস। রোদের তেজ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকায় আরও ঘন্টা দুয়েক বার্ডিং করে একটা পাহাড়ের তলায়( ডুংরি) জঙ্গলের মধ্যে ছায়ায় কিছুটা থাকলাম। দুরের পলাশের অসাধারণ দৃশ্য আমাদের চোখ এড়ালো না। গাড়িতে ওঠার আগে কয়েকটি মহুয়া গাছ চোখে পড়ল। সবমিলিয়ে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। রিসর্টে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম। বিকালে গন্তব্য চরিদা গ্রাম বা মুখোশ গ্রাম। ছৌ শিল্পের মুখোশ তৈরীর জন্য এই গ্রাম টি বিখ্যাত। প্রথমেই নয়ন সূএধর এর দোকানে গেলাম। শেষবার যখন এসেছিলাম তখনই আলাপ হয় নয়নের সাথে। বেশ কিছুক্ষণ নয়নের সাথে গল্প করলাম। এরপর পাশের দোকানের মনোরঞ্জন সূত্রধর এর সাথে আলাপ। বেশ কিছুক্ষণ এনার হাতের কাজ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের। কথা প্রসঙ্গে বললেন ছৌঁ শিল্পের কথা, তাদের নাচের কথা। কথায় কথায় জানতে পারলাম কোলকাতায় গিয়ে এই শিল্পী রা অনুষ্ঠান করলে 40/45 হাজার টাকার পারিশ্রমিক নেন। তিরিশ জনের এই গ্রুপ, সদস্যরা নিজেদের গাড়ী নিয়ে অনুষ্ঠান করতে যান। প্রায় তিন ঘণ্টার এক একটা পালা হয়। মনোরঞ্জন বাবু আরও বললেন বিগত বছর গুলোতে কোভিড পরিস্থিতিতে এই শিল্পকলা অনেকটাই মুখ থুবরে পড়েছে। এবার ফেরার পালা। লাল পলাশের দেশের ইতিহাস অনেক প্রাচীন ও ঐতিহাসিক তথ্যে সমৃদ্ধ।আমরা সকালের প্রাতরাশ সেরে যখন বেরোলাম তখন প্রায় সকাল এগারোটা l আমাদের গাড়ি অযোধ্যা হিলস এর রাস্তা ধরে ছুটতে শুরু করল ।ভুদার মোর পেরিয়ে কিছুটা গেলেই বান্দু সেতু। আর সেটা পেরিয়ে গেলেই দুদিকে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ আর লালের ছড়াছড়ি। পলাশ আর পলাশ। গাড়িতে উঠে ঠিক করলাম বরন্তী হয়ে ফিরবো। প্রায় 24 কিমি পথ পলাশ দেখতে দেখতে কখন যে ন্যাশনাল হাইওয়ে 32 ধরে ফেলেছি তার খেয়াল ছিল না l গাড়িতে যেতে যেতে গুগল ম্যাপ টা খুলে দেখলাম গড়পঞ্চকোট হয়ে গেলে ঘন্টাখানেক বেশী সময় লাগবে। তাই প্লান একটু চেঞ্জ করে ড্রাইভার কে বললাম গড় পঞ্চকোট চলো। প্রায় দুটো নাগাদ আমরা গড় পঞ্চকোট পৌঁছলাম। আদি কল্যাণেশ্বরী মন্দির, রাজমহল এর ধংসাবশেষ, গড় পঞ্চকোট পাহাড় ঘুরে দুপুরের লাঞ্চ চারুলতাতে করলাম। ভাত,ডাল, আলুপোস্ত, পোস্তর বড়া, রুই মাছের ঝাল, পাঁপড় আর চাটনি, আর ছেলে পাবলোর জন্য স্পেশাল চিকেন কারী। চারুলতা ক্যাফেটেরিয়া টি বেশ ছিমছাম, পরিষ্কার, খাবার ও বেশ ভাল, দাম নাগালের মধ্যেই। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বেরোতে যাব, এমন সময় স্ত্রী সোনালীর খুরততো ভাইদের সঙ্গে দেখা। বেশ কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে আমরা বরন্তী এর উদ্দেশ্যে বেরালাম । বরন্তী পৌঁছে লেকের ধারে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুললাম। এরপর আমাদের এইবারের ট্যুর এর শেষ গন্তব্যস্থল ভেটি গ্রাম। পলাশ দেখার শেষ ও প্রথম যদি কোনো জায়গা থাকে তবে তা এই ভেটি গ্রাম । আমরা গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে পলাশ বনের ভিতর দিয়ে এগোতে থাকলাম। প্রকৃতিকে এত কাছ থেকে দেখার এর থেকে আর কি ভালো হতে পারে। আকাশের নীল রঙের মধ্যে টকটকে লালের ঘনঘটা।কোন দিক ছেড়ে কোন দিকে তাকাবো, বোঝা দায়। মনের সাধে সবাই মিলে ছবি তুললাম। তবে মনের মণিকোঠায় যে রং লাগলো, তা যে সহজে ফিকে হবার নয় এটা ততক্ষণে বুঝে গেছি। আসতে আসতে সূর্য ডোবার পালা শুরু হল। টুপ করে সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এল। এবার ফেরার পালা। আবার পুরুলিয়ার মাটিতে ফিরে আসার ইচ্ছে নিয়ে গাড়ী তে গিয়ে বসলাম। পেছন থেকে পাবলোর ডাক….আবার আসতে হবে , পাপা। (ছবি: ডাঃ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়)