সৌম্যজিৎ চক্রবর্তী: আদুর গা, কখনও আবার শতচ্ছিন্ন স্যান্ডো গেঞ্জি। আর কোমরে দক্ষিণী স্টাইলে গোটানো হাঁটুর ওপর তোলা তেল চিটচিটে কালিঝুলি মাখা ময়লা লুঙ্গি। হাওড়ার দাশনগর-টিকিয়াপাড়ার ঢালাইঘর-লেদঘরে এ দৃশ্য আকছার। লোহার ঠুংঠাং, কখনওবা কর্কশ শব্দেও এঁরা লক্ষ্যে অবিচল, সৃষ্টিতে মগ্ন।
অনেকেই নিরক্ষর, কিন্তু কাজে চূড়ান্ত দক্ষ। পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও, কখনও কখনও বড়সড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রকৌশলবিদ্যা পড়ে আসা প্রযুক্তিবিদদের থেকেও অভিজ্ঞতায় দড় এঁরা। আসলে তাঁরা স্বয়ং “প্রাচ্যের শেফিল্ড” হাওড়ার একেকজন রক্ত-মাংসের বিশ্বকর্মা। পোশাকি নাম “ডেইলি লেবার”।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাঁদের কোনওকালেই মেলেনি যোগ্য সম্মান, এমনকি এখনও বেশিরভাগ সময়েই মেলেনা প্রাপ্য মজুরি। কর্মক্ষেত্রে অনেকসময়ই সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া তো দূরে থাক, বরং হপ্তা পেমেন্টের দিন ধানাইপানাই করা হয় কতটা টাকা কম দেওয়া যায়! অথচ তাঁদের কারিগরি গুণেই একদিন ব্রহ্মাণ্ডের ঐতিহাসিক আবিষ্কারে চিরতরে নাম উঠেছিল তাঁদের কর্মভূমি হাওড়ার। তবু ওইসব শ্রমিকশ্রেণীর ললাটলিখন আজও যেই কে সেই! জমানা বদলালেও তাঁদের অবস্থা বদলায়নি এতটুকুও। আজকের ‘আত্মনির্ভর ভারতের’ যুগেও লেদঘরের আঁধারেই কেটে যায় তাঁদের জীবনের সিংহভাগ। কিশোর বয়সে হাওড়ার কারখানায় কাজ করতে আসা থেকে শুরু করে অশক্ত, অসুস্থ, ন্যুব্জ বার্ধক্যের আগে পর্যন্ত। মেশিনের জান্তব গর্জনের আড়ালে চাপা থাকে তাঁদের নীরব হাহাকার, চাওয়া – না পাওয়ার হিসেবনিকেশ। ছাঁট-বাবরি আর লোহালক্কড়ের নীচে ঢাকা পড়ে যায় তাঁদের পূরণ না হওয়া কতশত সুপ্ত বাসনা। তবু ওঁরা থামেন না। ওঁদের হাতে গড়া যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি হয় ইতিহাস। লেখা হয় এ বিশ্ব-চরাচরের উপাখ্যান।
সালটা ২০১২। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর খোঁজ মিলল গডস পার্টিকল বা ঈশ্বর কণার। কিন্তু সেদিন জানা যায়নি জেনিভার অদূরে সার্ন গবেষণাগারে মাটির গভীরে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার যন্ত্রে ঈশ্বর কণার অস্তিত্ব নিয়ে যে গবেষণা করছিলেন বিজ্ঞানীরা, সেই গবেষণায় জুড়ে গিয়েছেন হাওড়ার লেদ কারখানার কয়েকজন শ্রমিকের নাম। তাঁরা এমন একটি যন্ত্রাংশ তৈরি করে ইতিহাস গড়েছিলেন, যা কাজে লাগে জেনিভার পরমাণু গবেষণাকেন্দ্র সার্নের ঈশ্বরকণা আবিষ্কারে।
মহাবিশ্বের সৃষ্টি-রহস্য উদঘাটনের জন্য সার্ন-এর ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার এক্সপেরিমেন্ট’-এর একটি অংশগ্রহণকারী সংস্থা কলকাতার ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্স’। তাদের কাছ থেকে গবেষণার জন্য বিশেষ একটি জিনিস তৈরির বরাদ পান হাওড়ার ধুলোগড়ের নরেন্দ্র অ্যান্ড নরেন্দ্র ইঞ্জিনিয়ারিং-এর রজনী মুখোপাধ্যায়। তাঁর থেকে অর্ডার পান হাওড়ারই ঘোষ ইন্ডাস্ট্রিজের গৌতম ঘোষ। তিনি তাঁর হেডমিস্ত্রী কালিপদ পরামানিককে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করে ফেলেন বিশাল ফ্রাস্টাম।
হেডমিস্ত্রি কালীপদবাবুর নেতৃত্বে শুরু হয় রাত-দিন এক করে কাজ। তৈরির পর সার্নের মাটির গভীরে তা লাগানোর সময় দেখা যায়, দৈত্যাকার যন্ত্রাংশগুলিতে একচুলও মাপ ভুল হয়নি। অন্য অনেক দেশের পাঠানো যন্ত্রের অংশের কাটাছেঁড়া করার প্রয়োজন পড়লেও হাওড়ার ওই খালি গায়ে কাজ করা মিস্ত্রিদের মাপজোক ছিল ১০০ শতাংশ নিখুঁত।
কিন্তু যাঁর নেতৃত্বে এত বড় কর্মকাণ্ড হলো সেই কালীপদ বাবুর না ছিল কোনও প্রথাগত ডিগ্রি, না ছিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পুঁথিগত বিদ্যা। পড়াশোনা বলতে চতুর্থ শ্রেণি পাশ। পেটের টানে ছোট বয়সেই ধরেছিলেন লেদ মেশিনের হাতল। জোগাড়ে থেকে হয়ে উঠেছিলেন পাকাপোক্ত মিস্ত্রি। যেসময়ের কথা, তখন মাত্র আড়াই হাজার টাকার মাসিক বেতনে কাজ করতেন কালীপদবাবু। তবে এই বিশাল কর্তব্য পালনের জন্য শুধু এককালীন পেয়েছিলেন মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।
আক্ষেপ, এত বড় কাজ করলেও কেউ ফিরেও তাকায়নি তাঁদের দিকে। এই কাজে তাঁর সঙ্গেই উচ্চারিত হয় বিফল রায়, প্রকাশ ভট্টাচার্যদের নাম। তাঁদেরও জীবন সংগ্রামের উপেক্ষিত কাহিনি অজানাই থেকে গেছে বিশ্ববাসীর কাছে। যে কাজের দায়িত্ব পেয়েও পিছিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া, সেই কাজই সাফল্যের সঙ্গে করে অসাধ্যসাধন করে দেখিয়েছিলেন এই কিংবদন্তীরা। দেখিয়ে দিয়েছিলেন পুঁথিগত ও প্রথাগত শিক্ষা না থেকেও, হাওড়ার এক স্যাঁতস্যাঁতে এঁদো গলির কারখানায় হলদেটে হয়ে যাওয়া নিভু নিভু আলোয় কাজ করেও বিশ্বজয় সম্ভব। তাঁদের তৈরি সূক্ষ্ম কাজ নজর কেড়েছিল বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের। তাঁদের হাতের ছোঁয়া রয়ে গিয়েছে বিশ্বের বৃহৎ গবেষণা যন্ত্র লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে।
তাঁরা অন্তরালে থাকলেও আদতে এতদিন পরে হলেও এই “জীবন্ত বিশ্বকর্মা”দের গড়া যন্ত্রাংশের দৌলতেই ইতিহাসের পাতায় পাকাপাকিভাবে নাম উঠেছে শিল্পে অতীত গৌরবের “প্রাচ্যের শেফিল্ড” হাওড়ার। অথচ ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের কোনও স্বীকৃতিই মেলেনি। ওঁরা সেই-ই থেকে গেছেন মহাকাব্যের উপেক্ষিত নায়ক হয়েই।
তথ্যসূত্র ও চিত্র: সংগৃহীত
এই সংবাদটি বাঙালীর গর্বের বিষয়। দুঃখের বিষয়, যাঁদের কথা লেখা হয়েছে, তাঁদের বিষয়ে তথাকথিত বড় বড় সংবাদমাধ্যমে কোনো উল্লেখ দেখেছি বলে মনে পড়েনা।
তাঁদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই।
আর, এই সংবাদটি প্রকাশ করার জন্য আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।