মে দিবসে সম্বর্ধিত হবেন ‘ঈশ্বরকণা’ আবিষ্কারে অন্তরালে থাকা হাওড়ার বিশ্বকর্মা 

Spread the love

সংবাদ সংস্থা: সালটা ২০১২। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর খোঁজ মিলল গডস পার্টিকল বা ঈশ্বর কণার। কিন্তু সেদিন জানা যায়নি জেনিভার অদূরে সার্ন গবেষণাগারে মাটির ১০০ মিটার গভীরে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার যন্ত্রে ঈশ্বর কণার অস্তিত্ব নিয়ে যে গবেষণা করছিলেন বিজ্ঞানীরা, সেই গবেষণায় জুড়ে গিয়েছেন হাওড়ার লেদ কারখানার কয়েকজন শ্রমিকের নাম। সেসময় বিশ্বের তাবড় সংবাদমাধ্যম তোলপাড় হয়েছিল ‘ঈশ্বরকণা’ হিগস-বোসনের সেই আবিষ্কারে। জেনেভার সার্নের সেই আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত আর এক গবেষণায় যে হাওড়ার বিশ্বকর্মাদের নাম জুড়ে আছে, তা অনেকেই জানেন না। মাত্র মাস তিনেকে হাওড়ার লেদ কারখানার সাধারণ কয়েকজন শ্রমিক একটি যন্ত্রাংশ তৈরি করে ইতিহাস তৈরি করেছেন। তাঁরা এমন এক যন্ত্রাংশ তৈরি করে দিয়েছিলেন, যা কয়েক বছর আগে কাজে লেগেছে জেনিভার পরমাণু গবেষণাকেন্দ্র সার্নের ঈশ্বরকণা আবিষ্কারে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় পরমাণু গবেষণাকেন্দ্র হল সার্ন (সিইআরএন)। ইংরেজি তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ’। সেখানে মাটির নিচে ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছে। সেই বৃত্তাকার সুড়ঙ্গপথ সুইৎজ়ারল্যান্ড, ফ্রান্স আর জার্মানি ছুঁয়ে গেছে। মহাবিশ্বের সৃষ্টি-রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য হবে দু’দিক থেকে ধেয়ে আসা অতি উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কণার সংঘর্ষ বা কলিশন। পরীক্ষা অনেকগুলো, সেই সব ক’টি নিয়ে ওই সুড়ঙ্গকেন্দ্রিক পরীক্ষার নাম দেওয়া হয়েছে, ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার এক্সপেরিমেন্ট’। এই বিশাল কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত সারা বিশ্বের প্রায় ১০,০০০ প্রথিতযশা বিজ্ঞানী, সারা বিশ্বজুড়ে এই কাজটি নানা দেশে করবার চেষ্টা করা হয়েছে, সকলেই সকলের মতো কাজ করেছেন। এটির এক অংশগ্রহণকারী সংস্থা কলকাতার ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্স’। তাদের কাছ থেকে কাজটি পান নরেন্দ্র এন্ড নরেন্দ্র ইঞ্জিনিয়ারিং-এর রজনী মুখোপাধ্যায় সেখান থেকে হাওড়ার ঘোষ ইন্ডাস্ট্রিজের গৌতম ঘোষ, তিনি তার হেডমিস্ত্রী কালিপদ পরামানিককে সঙ্গে নিয়ে এবছরের বেশী সময় ধরে তৈরি করে ফেলেন বিশাল ফ্রাস্টাম। সাহেবদের বিশ্বাস রাখতে ওই বিশাল বিশাল ফ্রাস্টামগুলোও কম্পিউটার সংযুক্ত কোঅর্ডিনেট মেজ়ারিং মেশিনে মেপে দেখানো হয়েছিল। সব থেকে মজার ব্যপার, সার্নের মাটির নীচে ৫৭৪ ফুট গভীরে লাগানোর সময় দেখা গেল যে, দৈত্যাকার যন্ত্রাংশগুলিতে এক চুলও মাপ ভুল হয়নি। অন্য অনেক দেশের পাঠানো অংশের কাটাছেঁড়া করতে হয়েছে। ইউরোপের একটি দেশের এক বড় ল্যাবরেটরিতে তৈরি অংশেরও কয়েক কেজি কেটে বাদ দিতে হয়েছিল, কিন্তু হাওড়ার ওই খালি গায়ে কাজ করা মিস্ত্রির মাপ ছিল ১০০ ভাগ নিখুঁত। কিন্তু যিনি এত বড় কর্মকাণ্ড করে ফেললেন সেই কালীপদ বাবুর না ছিল কোনও প্রথাগত ডিগ্রি, না ছিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পুঁথিগত বিদ্যা। পড়াশোনা বলতে চতুর্থ শ্রেণি পাশ। পেটের টানে ছোট বয়সেই ধরেছিলেন লেদ মেশিনের হাতল। হয়ে উঠেছিলেন পাকাপোক্ত মিস্ত্রি। বিশ্ব সৃষ্টির ইতিহাস জানার গবেষণায় এই মিস্ত্রির অবদান আজ অনস্বীকার্য। এই কাজে তাঁর সঙ্গেই উচ্চারিত হয় বিফল রায়, প্রকাশ ভট্টাচার্যদের নাম। যে কাজের দায়িত্ব পেয়েও পিছিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া, সেই কাজই তাঁরা করে দেখিয়েছেন ভারতের ‘শেফিল্ড’ হাওড়ার কদমতলা, দাশনগরের কারখানায়। অসাধ্য সাধন করেছেন এই জীবন্ত ‘বিশ্বকর্মা’রা। তাঁদের হাতে তৈরি সূক্ষ্ম কাজ নজর কেড়েছিল তাবড় বিজ্ঞানীদের। সেই কাজের স্বীকৃতি না মিললেও, তাঁদের ছোঁয়া থেকে গিয়েছে বিশ্বের বৃহৎ গবেষণা যন্ত্রে। বছর চুয়াত্তরের কালীপদবাবুর আক্ষেপ একটাই, ইতিহাসের সাক্ষী হয়েও সংসারের অনটন মেটাতে পারেননি কোনওদিন। তিনি নিজে যেমন হাইস্কুলে যেতে পারেননি, তেমনই আর্থিক সঙ্কটের কারণে তাঁর চার মেয়েও মাধ্যমিকের গণ্ডির ওপারে নিয়ে যেতে পারেননি। শত দুঃখেও মেয়েদের এই ত্যাগকে আজ তিনি উৎসর্গ করতে চান বিজ্ঞানের জন্য। কালীপদবাবু হাওড়ার শিবপুরের বাসিন্দা (বর্তমানে থাকেন হুগলির গরলগাছায়)। বিজ্ঞান আজও তাঁকে আকৃষ্ট করে। কারখানার একজন সাধারণ শ্রমিক হয়েও এভাবে ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। যা তাঁর মনের খিদে মেটালেও দু’বেলা ভাত জোটাতে পারেনি। স্বীকৃতি দেয়নি কেউই। সার্নের গবেষণাগারে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের একটি বিশেষ অংশে লাগানো রয়েছে কালীপদবাবু, বিফল রায়, প্রকাশ ভট্টাচার্যদের হাতে তৈরি যন্ত্রাংশ। বিশ্বের সৃষ্টির রহস্য উদঘাটনের জটিল পরীক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই সার্ন। তার একটি অংশে ‘এ লার্জ আয়ন কোলাইড এক্সপেরিমেন্ট’ বা এলিস হওয়ার কথা ছিল। তারই একটি যন্ত্রাংশ তৈরির দায়িত্ব ছিল রাশিয়ার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া সেই দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। তখন এই কাজ সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব বর্তায় ভারতের সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের (এসআইএনপি) উপর। এর জন্য সেখানকার বিজ্ঞানীরা যোগাযোগ করেছিলেন হাওড়ার বিভিন্ন লেদ কারখানার সঙ্গে। এই কাজে এগিয়ে আসেন এক কারখানার মালিক। তিনি নিজের প্রায় সমস্ত সম্পত্তিকে বেচে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই কাজে। তাঁর হাত ধরেই বরাত যায় আরেকটি ছোট এক কোম্পানির কাছে। সেখানেই কাজ করতেন কালীপদবাবু, বিফলবাবুরা। হেডমিস্ত্রি কালীপদবাবুর নেতৃত্বে শুরু হয় রাত-দিন এক করে কাজ। তখন মাত্র আড়াই হাজার টাকার মাসিক বেতনে কাজ করতেন কালীপদবাবু। এই সামান্য টাকায় কীভাবে সংসার চলত, তা তিনিই জানেন! এমনকী পরবর্তীকালে ইতিহাস তৈরি করেও ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারেননি তিনি। কর্তব্য পালনের জন্য এককালীন পেয়েছিলেন মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। ডাল-ভাত জোগাড়ের জন্য কারখানার পাশাপাশি রাতে জরির কাজও করতে হয়েছে তাঁকে। একটা সময় চিকিৎসার টাকাও জোগাড় করতে পারেননি কালীপদবাবু। হুগলির নবাবপুরের একচিলতে ঘর বৃষ্টি হলেই ভেসে যেত। বছরের পর বছর কেটে গেলেও কেউ এই পরিবারের খোঁজ নেয়নি। বর্তমানে ছেলে শশাঙ্ক সংসারের হাল ধরায়, জীবন সায়াহ্নে এসে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন সত্তরোর্ধ্ব এই ‘বিজ্ঞানী’। তিনি বলেন, এত বড় কাজ করলেও কেউ ফিরে তাকায়নি। আমাদের ওই কাজ কি দেশের জন্য ছিল না? কালীপদবাবু বলেন, স্বল্প হলেও বিশ্ব সৃষ্টির ইতিহাস জানার গবেষণায় আমার অবদান থাকায় আমি তৃপ্ত। কারখানার মালিক গৌতম ঘোষ, বিফল, প্রকাশ ভট্টাচার্যদের স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকব। আজ, রবিবার মে দিবসে মন্ত্রী অরূপ রায়ের উদ্যোগে হাওড়ার শরৎসদনে সংবর্ধিত হবেন রক্তমাংসের এই ‘বিশ্বকর্মা’। তাঁর জীবন সংগ্রামের উপেক্ষিত কাহিনি অজানাই থেকে যাবে বিশ্ববাসীর কাছে। আর সব কিছুর আড়ালে তিনি থেকে যাবেন জীবন্ত কিংবদন্তী হয়েই। তথ্য ও ছবি: সংগৃহীত
Spread the love

One Reply to “মে দিবসে সম্বর্ধিত হবেন ‘ঈশ্বরকণা’ আবিষ্কারে অন্তরালে থাকা হাওড়ার বিশ্বকর্মা ”

  1. এটাই হাওড়া যাকে বলা হতো শেফিল্ড, হাওড়া বাসী হিসাবে গর্ব হয় এই রিপোর্ট সুন্দর ভাবে করার জন্য সৌম্যাজিত কে জানাই অভিনন্দন কালীপদ বাবু,গৌতম বাবুদের মত আরো ছোটো ছোটো কারখানা গুলি থেকে খুঁজে বের করতে হবে এই রকম বিশ্বকর্মা দের তারাই তো আমাদের গর্ব,ও ভবিষ্যত, এমএস এম ই তে আজও পশ্চিমবঙ্গ ভারত সেরা এনাদের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাই হাওড়ার শ্রমিক বন্ধুদের

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।