সৌম্যজিৎ চক্রবর্তী: কে বলে খুঁজলে যকের ধন মেলেনা? এ যুগে দাঁড়িয়েও যদি মহাভারতের আমলের গাছের হঠাৎই দেখা মেলে, সেই প্রাপ্তি যকের ধনের থেকে কম কীসে? আমাদের রাজ্যেরই এক জেলায় রয়েছে তেমনই এক গাছ। মহাভারতে তেরো বছরের বনবাস শেষে এক বছরের জন্য যখন দ্রৌপদী সহ পঞ্চপাণ্ডব অজ্ঞাতবাসে গেলেন, তখন তাঁরা তাঁদের অস্ত্র একটি গাছের গর্তে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। নাম তার শমী বৃক্ষ। বিরাট রাজ্যে যাওয়ার সময় যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল সহদেব ছদ্মবেশ ধারণ করে যখন কংক, বল্লভ, বৃহন্নলা, তন্ত্রীপাল ও গ্রন্থিক নাম নেন তখন তাঁরা শমী বৃক্ষের কোটরেই যুদ্ধাস্ত্র রেখে গিয়েছিলেন। শুধু মহাভারত নয়, এই গাছের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও অনেক কিংবদন্তি। অনেকে বলেন, মহাকবি কালীদাসও এই গাছের নিচে বসেই বিদ্যার্জন করতেন। কিন্তু কোথায় গেলে মিলবে সে গাছের দেখা? এ’রাজ্যেরই দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় রয়েছে শমী গাছ। এই গাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্রও। শমী বৃক্ষের পাশে থাকা দীঘির চারপাশে তৈরি করা হয়েছে পর্যটকদের জন্য কটেজ। অনেকে আবার বিশ্বাস করেন হরিরামপুরের বৈরাটা গ্রাম একসময় বিরাট রাজার রাজ্য ছিল। একসময় এখানে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর বিশাল প্রাসাদ। মূলত দক্ষিণ দিনাজপুরের হাতিডুবা গ্রামে গেলেই এই গাছ দেখতে পাওয়া যাবে। দক্ষিণ দিনাজপুরের সদর শহর বালুরঘাট থেকে বাসে করে হাতিরামপুরে নেমে, সেখান থেকে যেকোনও ছোট গাড়ি করে হাতিডুবা গ্রামে যাওয়া যায়। আবার কুশমণ্ডি যাওয়ার পথে নারায়ণপুর হাই স্কুলের পাশ দিয়েও যাওয়া যায় হাতিডুবা গ্রামে। অনেকে আবার বলেন, হরিরামপুরের বৈরাটা গ্রাম একসময় বিরাট রাজার রাজ্য ছিল। পৌষ মাসের বকুল অমাবস্যা তিথিতে ৫১ জন কুমারী মেয়ে লালপেড়ে শাড়ি পরে ৫১টি শঙ্খ ও ৫১টি ঢাক নিয়ে শোভাযাত্রা করে আত্রেয়ী থেকে অভিষেকের জল আনে। তিন দিন ব্যাপী মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় এখানে। দক্ষিণ দিনাজপুরের পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকে ও মহারাষ্ট্রে শমী বৃক্ষ দেখতে পাওয়া যায়। এই দুই রাজ্যে বিশেষ কদর রয়েছে এই গাছের। শাস্ত্রে শমী গাছকে অত্যন্ত শুভ মনে করা হয়। বলা হয়, এই গাছ বাড়িতে থাকলে বাধা বিঘ্ন দূর হয়। জ্যোতিষ মতেও শমী গাছের অগাধ গুরুত্ব। বলা হয়, শমী শনির কারক। আবার ধনিষ্ঠা নক্ষত্রের কারকও শমী বৃক্ষই। কোষ্ঠি যাচাই করে সঠিক দিকে শমী গাছ লাগানো উচিত। বায়ব্য শনির দিক। এই গাছের পুজো করলে শনির প্রকোপ শান্ত হয়। কারণ শমীকে সাক্ষাৎ শনির স্বরূপ মনে করা হয়। শনির বাধা দূর করতে চাইলে শমীর গাছ লাগানো হয়। আবার বিজয়াদশমীতে সোনা-রুপো হিসেবে শমীর পাতা বিতরণ করা হয়। বিজয়াদশমীর দিনে শমী গাছের পুজো করলে পরিবারে তন্ত্র-মন্ত্রের প্রভাব দূর হয়। কখনও অর্থের অভাব হয় না। এও মনে করা হয় যে, খোদ গণেশ ঠাকুরের নাকি একটি প্রিয় গাছ এই শমী। বুধবার গণেশকে শমীর পাতা অর্পণ করলে জাতক তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী হয়। এর পাশাপাশি কলহের অবসান ঘটে। যেখানে এই গাছ লাগানো থাকে এবং নিয়মিত পুজো করা হয়, সেখান থেকে বিপদ দূর হয়। প্রদোষ কালে শনি গাছের সম্মুখে গিয়ে প্রণাম করে, জল অর্পণ করে, গাছের সামনে প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করে, শমী পুজোর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রও উচ্চারণ করে নিয়ম মেনে পুজো করলে সমস্ত কষ্ট দূর হয় এবং সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি লাভ করা যায়। এছাড়া বলা হয়, শ্রাবণ মাসের যে কোনও শনিবার এই গাছ রোপন করা যেতে পারে। বাড়ির মুখ্য দ্বারের বাঁ দিকে এই গাছ লাগানো শুভ মনে করা হয়। শুধু মহাভারতের জন্যই খ্যাত নয় শমী বৃক্ষ। আয়ুর্বেদেও শমী গাছকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এই গাছের ব্যবহার প্রচুর। ওষুধ তৈরি হয় শমী গাছ থেকে। এছাড়াও আয়ুর্বেদ অনুযায়ী কৃষি সঙ্কটেও এই গাছের ফলে লাভ হয়। শমীবৃক্ষের বৈজ্ঞানিক নাম Prosopis cineraria, Fabacea পরিবারের অন্তর্গত উদ্ভিদের পাতা খানিক লজ্জাবতী গাছের পাতার ন্যায়। শমীবৃক্ষ মরু অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়া সত্ত্বেও বরেন্দ্রভূমে এল কীভাবে সেসব নিয়ে অবশ্য ধোঁয়াশা রয়েছে। সবথেকে উল্লেখযোগ্যের বিষয় এই অঞ্চলে কেবল একটি মাত্রই শমীবৃক্ষের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মহাভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষী লালন করছে যে বরেন্দ্রভূমি সে আজও নিঃশব্দে বহন করে চলেছে সময়ের স্রোতস্বিনী। শমী বৃক্ষ ইতিহাসের পাতায় কয়েক হাজার বছরের জীবন্ত দলিল হয়ে এখনো বেঁচে আছে। তার বৃদ্ধ তকমা পেতে হয়তো আরো কয়েকশো বছরের অপেক্ষা। সেই শতাব্দী প্রাচীন মহীরুহ আজও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে মানুষের বিশ্বাস ও ভক্তিকে। তথ্য ও ছবি সৌজন্যে: আন্তর্জাল
সৌম্যজিৎ চক্রবর্তী: কে বলে খুঁজলে যকের ধন মেলেনা? এ যুগে দাঁড়িয়েও যদি মহাভারতের আমলের গাছের হঠাৎই দেখা মেলে, সেই প্রাপ্তি যকের ধনের থেকে কম কীসে? আমাদের রাজ্যেরই এক জেলায় রয়েছে তেমনই এক গাছ। মহাভারতে তেরো বছরের বনবাস শেষে এক বছরের জন্য যখন দ্রৌপদী সহ পঞ্চপাণ্ডব অজ্ঞাতবাসে গেলেন, তখন তাঁরা তাঁদের অস্ত্র একটি গাছের গর্তে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। নাম তার শমী বৃক্ষ। বিরাট রাজ্যে যাওয়ার সময় যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল সহদেব ছদ্মবেশ ধারণ করে যখন কংক, বল্লভ, বৃহন্নলা, তন্ত্রীপাল ও গ্রন্থিক নাম নেন তখন তাঁরা শমী বৃক্ষের কোটরেই যুদ্ধাস্ত্র রেখে গিয়েছিলেন। শুধু মহাভারত নয়, এই গাছের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও অনেক কিংবদন্তি। অনেকে বলেন, মহাকবি কালীদাসও এই গাছের নিচে বসেই বিদ্যার্জন করতেন। কিন্তু কোথায় গেলে মিলবে সে গাছের দেখা? এ’রাজ্যেরই দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় রয়েছে শমী গাছ। এই গাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্রও। শমী বৃক্ষের পাশে থাকা দীঘির চারপাশে তৈরি করা হয়েছে পর্যটকদের জন্য কটেজ। অনেকে আবার বিশ্বাস করেন হরিরামপুরের বৈরাটা গ্রাম একসময় বিরাট রাজার রাজ্য ছিল। একসময় এখানে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর বিশাল প্রাসাদ। মূলত দক্ষিণ দিনাজপুরের হাতিডুবা গ্রামে গেলেই এই গাছ দেখতে পাওয়া যাবে। দক্ষিণ দিনাজপুরের সদর শহর বালুরঘাট থেকে বাসে করে হাতিরামপুরে নেমে, সেখান থেকে যেকোনও ছোট গাড়ি করে হাতিডুবা গ্রামে যাওয়া যায়। আবার কুশমণ্ডি যাওয়ার পথে নারায়ণপুর হাই স্কুলের পাশ দিয়েও যাওয়া যায় হাতিডুবা গ্রামে। অনেকে আবার বলেন, হরিরামপুরের বৈরাটা গ্রাম একসময় বিরাট রাজার রাজ্য ছিল। পৌষ মাসের বকুল অমাবস্যা তিথিতে ৫১ জন কুমারী মেয়ে লালপেড়ে শাড়ি পরে ৫১টি শঙ্খ ও ৫১টি ঢাক নিয়ে শোভাযাত্রা করে আত্রেয়ী থেকে অভিষেকের জল আনে। তিন দিন ব্যাপী মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় এখানে। দক্ষিণ দিনাজপুরের পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকে ও মহারাষ্ট্রে শমী বৃক্ষ দেখতে পাওয়া যায়। এই দুই রাজ্যে বিশেষ কদর রয়েছে এই গাছের। শাস্ত্রে শমী গাছকে অত্যন্ত শুভ মনে করা হয়। বলা হয়, এই গাছ বাড়িতে থাকলে বাধা বিঘ্ন দূর হয়। জ্যোতিষ মতেও শমী গাছের অগাধ গুরুত্ব। বলা হয়, শমী শনির কারক। আবার ধনিষ্ঠা নক্ষত্রের কারকও শমী বৃক্ষই। কোষ্ঠি যাচাই করে সঠিক দিকে শমী গাছ লাগানো উচিত। বায়ব্য শনির দিক। এই গাছের পুজো করলে শনির প্রকোপ শান্ত হয়। কারণ শমীকে সাক্ষাৎ শনির স্বরূপ মনে করা হয়। শনির বাধা দূর করতে চাইলে শমীর গাছ লাগানো হয়। আবার বিজয়াদশমীতে সোনা-রুপো হিসেবে শমীর পাতা বিতরণ করা হয়। বিজয়াদশমীর দিনে শমী গাছের পুজো করলে পরিবারে তন্ত্র-মন্ত্রের প্রভাব দূর হয়। কখনও অর্থের অভাব হয় না। এও মনে করা হয় যে, খোদ গণেশ ঠাকুরের নাকি একটি প্রিয় গাছ এই শমী। বুধবার গণেশকে শমীর পাতা অর্পণ করলে জাতক তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী হয়। এর পাশাপাশি কলহের অবসান ঘটে। যেখানে এই গাছ লাগানো থাকে এবং নিয়মিত পুজো করা হয়, সেখান থেকে বিপদ দূর হয়। প্রদোষ কালে শনি গাছের সম্মুখে গিয়ে প্রণাম করে, জল অর্পণ করে, গাছের সামনে প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করে, শমী পুজোর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রও উচ্চারণ করে নিয়ম মেনে পুজো করলে সমস্ত কষ্ট দূর হয় এবং সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি লাভ করা যায়। এছাড়া বলা হয়, শ্রাবণ মাসের যে কোনও শনিবার এই গাছ রোপন করা যেতে পারে। বাড়ির মুখ্য দ্বারের বাঁ দিকে এই গাছ লাগানো শুভ মনে করা হয়। শুধু মহাভারতের জন্যই খ্যাত নয় শমী বৃক্ষ। আয়ুর্বেদেও শমী গাছকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এই গাছের ব্যবহার প্রচুর। ওষুধ তৈরি হয় শমী গাছ থেকে। এছাড়াও আয়ুর্বেদ অনুযায়ী কৃষি সঙ্কটেও এই গাছের ফলে লাভ হয়। শমীবৃক্ষের বৈজ্ঞানিক নাম Prosopis cineraria, Fabacea পরিবারের অন্তর্গত উদ্ভিদের পাতা খানিক লজ্জাবতী গাছের পাতার ন্যায়। শমীবৃক্ষ মরু অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়া সত্ত্বেও বরেন্দ্রভূমে এল কীভাবে সেসব নিয়ে অবশ্য ধোঁয়াশা রয়েছে। সবথেকে উল্লেখযোগ্যের বিষয় এই অঞ্চলে কেবল একটি মাত্রই শমীবৃক্ষের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মহাভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষী লালন করছে যে বরেন্দ্রভূমি সে আজও নিঃশব্দে বহন করে চলেছে সময়ের স্রোতস্বিনী। শমী বৃক্ষ ইতিহাসের পাতায় কয়েক হাজার বছরের জীবন্ত দলিল হয়ে এখনো বেঁচে আছে। তার বৃদ্ধ তকমা পেতে হয়তো আরো কয়েকশো বছরের অপেক্ষা। সেই শতাব্দী প্রাচীন মহীরুহ আজও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে মানুষের বিশ্বাস ও ভক্তিকে। তথ্য ও ছবি সৌজন্যে: আন্তর্জাল